বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক:১৯৭১ সালের পরাজিত অপশক্তি আজ আদা-জল খেয়ে নেমেছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারকে অসাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় উৎখাত করার জন্য, আর এ উদ্দেশ্যে তারা অপব্যবহার করছে নতুন প্রযুক্তিতে উৎকর্ষিত ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ প্রভৃতি সামাজিকমাধ্যম। এ ষড়যন্ত্রকারীদের কয়েকজন বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে তাদের দুষ্কৃতিপূর্ণ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করলেও অধিকাংশই কাজ চালাচ্ছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বসে। যারা বাংলাদেশে অবস্থান করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হলেও যারা বিদেশে রয়েছে তারা বর্তমানে অনেকটাই ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমরা বিদেশে অবস্থানরত ষড়যন্ত্রকারীর নাম জানি। এদের অনেকের বিরুদ্ধেই বাংলাদেশের বিভিন্ন আদালতের জারিকৃত হুলিয়া রয়েছে বিধায় এরা ফেরারি আসামি, তার পরও বর্তমান প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে এরা প্রতিনিয়ত চালিয়ে যাচ্ছে দেশবিরোধী অপতৎপরতা। এদের আইনের আওতায় আনতে অনেকটা অসহায় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট মাননীয় মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার- যিনি এ বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ -সহ ইনফরমেশন টেকনোলজির বিশেষজ্ঞরা। তাদের কথা অনুযায়ী আমরা এসব অপরাধীর বিরুদ্ধে আইনি হস্তক্ষেপ নিতে সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল রয়েছি সেসব ব্যক্তি এবং সংস্থার ওপর যারা সামাজিকমাধ্যমগুলো, ফেসবুক, টুইটার, গুগল, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ ইত্যাদির অধীশ্বর। বাংলাদেশ সরকার বারবার তাদের কাছে দাবি পেশ করেও ব্যর্থ হয়েছে। তারা সব সময়ই এ মর্মে যুক্তি প্রদর্শন করছে যে এদের লেখালেখি বন্ধ করার জন্য বাংলাদেশে কোনো আইন নেই এবং এদের মুখ বন্ধ করা হবে মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিধান খর্ব করা।
শুধু বাংলাদেশই নয়, পৃথিবীর অনেক দেশই বিদেশে বসে সংশ্লিষ্ট দেশের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণার ভুক্তভোগী হয়ে তাদের নিজ নিজ দেশে কার্যকর আইন প্রণয়ন করেছে। এ ধরনের একটি ঘটনা ঘটেছিল যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কেন্দ্র করে। ২০১৪ সালের জুনে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনবিশারদ জোনাথন জিট্রেইন লিখেছিলেন, ‘ফেসবুক একটি দেশের নির্বাচনকেও প্রভাবিত করতে পারে, সবার অজ্ঞাতে।’ ২০১৬ সালের এপ্রিলে রব মেয়ার লিখেছিলেন কীভাবে ফেসবুক ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছিল। ২০১৬ সালের নির্বাচনের পর রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প ফেসবুক ও টুইটারের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় সমালোচনা এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের পর প্রথমে সংস্থা দুটির মালিকরা আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য মত প্রকাশের স্বাধীনতার যুক্তি তুলে ট্রাম্পের দাবির জবাব দিলেও পরবর্তীতে বাধ্য হয়েছিলেন দোষ স্বীকার করে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে এবং ভবিষ্যতে ‘ভুয়া প্রকাশনা’ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিতে। সামাজিকমাধ্যমে ভুয়া প্রকাশনায় অতিষ্ঠ হয়ে যেসব রাষ্ট্র নতুন আইন প্রণয়ন করেছে তার মধ্যে রয়েছে যুক্তরাজ্যও, যে দেশটিকে গণতন্ত্রের সূতিকাগার বলা হয়। সতের শতকে ‘শিপমানি’ নামে পরিচিত এক মামলার রায় প্রদানকালে ব্রিটিশ হাই কোর্ট বলেছিল, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তাই দেশের সর্বোচ্চ আইন।’ যুক্তরাজ্যে মত প্রকাশে স্বাধীনতা সেই ‘মেগনা কার্টার’ সময় থেকে স্বীকৃত হলেও এ স্বাধীনতা যে নিরঙ্কুশ নয় তা বারবারই প্রতিষ্ঠিত করেছে বিলেতের আদালতগুলো বিশেষ করে যখন রাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত থাকে। একই কারণে যুক্তরাজ্যের হাউস অব লর্ডস ১৯৮৪ সালে জি সি এইচ কিউ মামলায় গোপন যোগাযোগ কেন্দ্রে চাকরিরতদের ট্রেড ইউনিয়ন খোলার বিপক্ষে রায় প্রদান করেছিল।
১৯৮০-এর দশকে পিটার রাইট নামক ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা, এমআই-৫-এর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তার জীবনীগ্রন্থ ‘স্পাই কেচার’ ছাপানোর চেষ্টা এবং সেটি ধারাবাহিকভাবে বিলেতের গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশের চেষ্টা করলে ১৯৮৬ সালে ব্রিটিশ সরকার এই কারণ দেখিয়ে সেটি প্রকাশনার বিরুদ্ধে আদালত থেকে ইনজাংকশন নিয়েছিল যে এর ফলে যুক্তরাজ্যের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। পরবর্তীতে বইটি যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার আদালতের রায়ক্রমে প্রকাশিত হলে সেটি বিলেতের টাইমস এবং অবজারভার পত্রিকায় প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করলে ব্রিটিশ সরকার ওই প্রকাশনার বিরুদ্ধে আদালতে যায়। ‘অ্যাটর্নি জেনারেল বনাম অবজারভার পত্রিকা’ নামক মামলাটি ক্রমান্বয়ে বিলেতের সর্বোচ্চ আদালত হাউস অব লর্ডসে পৌঁছলে ১৯৮৮ সালে সেই আদালত অ্যাটর্নি জেনারেলের আপিল মঞ্জুর করে এ মর্মে রায় প্রদান করে যে ‘স্পাই কেচার’ পুস্তকে লেখা কথাগুলো ছাপালে যুক্তরাজ্যের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। হাউস অব লর্ডস তাদের রায়ে এ কথাও পুনরায় ব্যক্ত করে যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ হতে পারে না বরং প্রয়োজনীয় বিধিনিষেধ দ্বারা সীমিত। পরবর্তীকালে ইউরোপীয় মানবাধিকার কনভেনশনের বিধানাবলিকে ১৯৯৮ সালে হিউম্যান রাইটস অ্যাক্ট দ্বারা যুক্তরাজ্যের অভ্যন্তরীণ আইনে পরিণত করলে অন্যান্য মানবাধিকারের মতো মত প্রকাশের স্বাধীনতাও, যা আগে ছিল ইংলিশ কমন ল-ভিত্তিক বিধান তা বিধিবদ্ধ আইনের মর্যাদাপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু ইউরোপীয় কনভেনশনের ১০ অনুচ্ছেদেও মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর রয়েছে সেসব সীমাবদ্ধতা যা প্রকাশ করলে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে, কোনো ব্যক্তির মানহানি হতে পারে, সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে, আইনশৃঙ্খলা নষ্ট হতে পারে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হতে পারে, আদালত অবমাননা হতে পারে। একই ধরনের সীমাবদ্ধতা ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘে গৃহীত সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ২৯(খ) অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘নিজের অধিকার ভোগ করার সময় এ কথা প্রত্যেকেরই মনে রাখতে হবে যে তাতে যেন অন্যের অধিকার ও স্বাধীনতার প্রতি কোনোরূপ অস্বীকৃতি বা অশ্রদ্ধা প্রকাশ না পায়। অধিকন্তু একটি গণতান্ত্রিক সমাজে নৈতিকতা, গণশৃঙ্খলা ও সর্বসাধারণের দিকে লক্ষ্য রেখে এবং আইন মান্য করেই প্রত্যেকে তার অধিকার ও স্বাধীনতা প্রয়োগ করতে পারবে।’ ২৯(গ) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘এসব অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করার সময় কোনোক্রমেই জাতিসংঘের উদ্দেশ্য ও মূলনীতি লঙ্ঘন করা চলবে না।’
যুক্তরাজ্যে ভুয়া এবং আপত্তিকর প্রকাশনার বিরুদ্ধে আগে থেকেই বেশ কিছু আইন বলবৎ ছিল। তার পরও নতুন প্রযুক্তির অপব্যবহার দ্বারা ভুয়া এবং আপত্তিকর প্রকাশনা বন্ধ করার জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্ট একাধিক নতুন আইন প্রণয়ন করেছে। নতুন পরিস্থিতিতে যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করাই সমীচীন, কেননা পুরনো আইন অনেক ক্ষেত্রেই নতুন পরিস্থিতি মোকাবিলায় অকার্যকর হয়ে পড়ে। এমনই একটি নতুন ব্যবস্থা ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ প্রণয়ন করে সৃষ্টি করেছে যার নাম অফিস অব কমিউনিকেশন (অফকম)। কিন্তু এ সংস্থা শুধু টেলিভিশনের প্রচারণার ওপর নজরদারি করার অধিকারী। সামাজিকমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাজ্যের সফল আইন এখনো ২০০৩ সালের ‘দি কমিউনিকেশন অ্যাক্ট’। এ আইনের বলে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোনো ভুয়া, আক্রমণাত্মক, অপ্রীতিকর, অশ্লীল, ভীতি প্রদর্শনমূলক বার্তা বৈদ্যুতিক প্রক্রিয়ায় চালিত প্রচারমাধ্যম অপব্যবহার করে পাঠালে সে শাস্তিযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত হবে। যুক্তরাজ্যে মানহানির এবং আদালত অবমাননা রোধে আইন থাকার পরে এ আইনটি প্রণয়ন করা হয় এই ভেবে যে বৈদ্যুতিক প্রক্রিয়ার সামাজিক গণমাধ্যমের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় পুরনো আইনগুলো, যথা মানহানির আইন বহুলাংশে অকেজো হয়ে পড়ে।
২০১৮ সালের ২৯ জুলাই যুুক্তরাজ্যের আইনপ্রণেতারা ‘জাতীয় নিরাপত্তা যোগাযোগ ইউনিট’ নামে একটি বিশেষ সংস্থা গঠন করেন, যার কাজ হলো ভুয়া, আপত্তিকর, আক্রমণাত্মক, ভীতি প্রদর্শনমূলক তথ্য এবং সংবাদ প্রতিহত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ। এরপর ২০১৯ সালের এপ্রিলে যুক্তরাজ্যে জারি করা হয় ‘সামাজিক গণমাধ্যম কোড অব প্র্যাকটিস’, যার দ্বারা সামাজিক গণমাধ্যম পরিচালক/মালিকদের যথা ফেসবুক, টুইটার, গুগলস, হোয়াটসঅ্যাপ প্রভৃতির ওপর দায় বর্তানো হয় আপত্তিকর প্রচার এবং প্রকাশনার ক্ষেত্রে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করার। এ ছাড়া ১৯৯৮ সালে জারিকৃত ‘মেলিসাস কমিউনিকেশন আইন’ করা হয় যাতে কেউ অশ্লীল, মারাত্মকভাবে আক্রমণাত্মক, ভুয়া তথ্য/সংবাদ বৈদ্যুতিক প্রক্রিয়ায় চালিত মাধ্যম ব্যবহার করে পাঠালে তার শাস্তির বিধান করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ফেসবুক, টুইটার, গুগলস, হোয়াটসঅ্যাপে উপরোল্লিখিত আইন ও ব্যবস্থার প্রবল বিরোধিতা করেছিল এ যুক্তি দেখিয়ে যে এসব আইন/ব্যবস্থা ইউরোপীয় মানবাধিকার কনভেনশনের ১০ অনুচ্ছেদ দ্বারা প্রদত্ত মত প্রকাশের অধিকারবিরোধী। কিন্তু ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ এসব সামাজিকমাধ্যম মালিকদের বোঝাতে সক্ষম হন যে ওই কনভেনশনের ১০ অনুচ্ছেদেই বলা হয়েছে- মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ নয়, বরং আপেক্ষিক, যে অধিকার কাউকেই এমন কোনো মত বা তথ্য প্রচার/প্রকাশের স্বাধীনতা প্রদান করে না যা সংশ্লিষ্ট দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে পারে, সে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি হুমকির সম্মুখীন করতে পারে, সম্প্রদায়সমূহের মধ্যে অসন্তোষ, বিভেদ বা কলহ সৃষ্টি করতে পারে, কারও মানহানি ঘটাতে পারে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী এবং সামরিক বাহিনীকে উসকানি দিতে পারে। এসব যুক্তির পর উল্লিখিত কোম্পানিগুলো অবশেষে ব্রিটিশ দাবির কাছে মাথা নত করে সামাজিক গণমাধ্যমে আপত্তিকর প্রকাশনা খর্ব করার সিদ্ধান্ত নেয়, যেমনটি তারা ২০১৬ সালের যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের পরও সে দেশের ক্ষেত্রে নিয়েছিল। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট একই উদ্দেশ্যে আরও যেসব নতুন আইন প্রণয়ন করেছে বা আইনে পরিবর্তন এনেছে তার মধ্যে রয়েছে- ১৯৮৬ সালের পাবলিক অর্ডার অ্যাক্ট, ১৯৮৯ সালের অফিশিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট, ১৯৮৯ সালের সিকিউরিটি সার্ভিস অ্যাক্ট, ১৯৯৪ সালের ইন্টেলিজেন্টস সার্ভিসেস অ্যাক্ট, ১৯৯৪ সালের ক্রিমিনাল জাস্টিস অ্যান্ড পাবলিক অর্ডার অ্যাক্ট, ১৯৯৮ সালের ক্রাইম অ্যান্ড ডিজঅনার অ্যাক্ট, ২০০০ সালের ফ্রিডম অব ইনফরমেশন অ্যাক্ট, ২০০০ সালের টেররিজম অ্যাক্ট, ২০০১ সালের অ্যান্টি টেররিজম, ক্রাইম অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাক্ট, ২০০৩ সালের অ্যান্টি সোশ্যাল বিহেভিয়ার অ্যাক্ট, ২০০৫ সালের প্রিভেনশন অব টেররিজম অ্যাক্ট, ২০০৬ সালের টেররিজম অ্যাক্ট, ২০০৭ সালের সিরিয়াস ক্রাইম অ্যাক্ট, ২০০৮ সালের কাউন্টার টেররিজম অ্যাক্ট। ব্রিটিশ সরকার সম্প্রতি পাকিস্তানের মুত্তাহিদা-কওমি-মুভমেন্ট ইন পাকিস্তান (এমকিউএম) দলের নেতা আলতাফ হোসেনের বিচার শুরু করেছে ২০০৭ সালের সিরিয়াস ক্রাইম অ্যাক্টের ৪৪ ধারা এবং সন্ত্রাসবিরোধী আইন মতে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে যে তিনি যুক্তরাজ্যে বসে ২০১৬ সালের আগস্টে পাকিস্তানবিরোধী বিবৃতি প্রদান করেছিলেন। আলতাফ হোসেনের বিচার ও বিচারের জন্য ব্যবহৃত সংশ্লিষ্ট আইনগুলো আবার প্রমাণ করল যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সীমাহীন নয়। খুনের দায়ে দণ্ডিত বিলেতে পালিয়ে থাকা ফেরারি আসামি তারেক রহমানসহ অন্যরা প্রতিনিয়ত বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্য বিলেতে বসে প্রচার করে যাচ্ছে। অভিজ্ঞ মহল মনে করে তাদের বিরুদ্ধেও আলতাফ হোসেনের মতোই ফৌজদারি মামলা হতে পারে, যার জন্য প্রয়োজন এসব অপরাধীর বক্তব্যগুলো ব্রিটিশ সরকারের নজরে আনা। যুক্তরাজ্যে প্রণীত আইনগুলোর কারণে এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ নয় মর্মে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মালিকদের বোঝাতে সক্ষম হওয়াতে সেই মালিকগুলো এখন ব্রিটিশ সরকারের দাবির কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছে। সামাজিক গণমাধ্যমে বিকৃত, ভুয়া, আক্রমণাত্মক, রাষ্ট্রবিরোধী প্রচার-প্রচারণা রোধকল্পে ভারত সরকার অত্যন্ত কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে বেশ কিছু আইন প্রণয়ন এবং ব্যবস্থা গ্রহণ করে সামাজিকমাধ্যম কোম্পানিগুলোকে তাদের কথা শুনতে বাধ্য করেছে। একইভাবে এসব কোম্পানি মত প্রকাশের স্বাধীনতার ধুয়া তুলে প্রথম দিকে গড়িমসি করলেও পরে ভারতের যুক্তির কাছে পরাজয় স্বীকারে বাধ্য হয়। ভারত সরকার সামাজিকমাধ্যম কোম্পানিগুলোর মালিকদের এ মর্মে বোঝাতে সক্ষম হয় যে ভারতের সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদে মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিধান নিরঙ্কুশ নয়, বরং বহু শর্ত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। অনুচ্ছেদ ১৯ (২)-এ বলা আছে, এই স্বাধীনতার কারণে এর ওপর যুক্তিসংগত বিধিনিষেধ আরোপের কোনো আইন অকার্যকর হবে না, যা ভারতের স্বাধীনতা, অখণ্ডতার জন্য, নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা, জননিরাপত্তা, শালীনতা, নৈতিকতা, আদালত অবমাননা, মানহানি এবং অপরাধ রোধকল্পে প্রয়োজন। ভারত সরকার আরও যুক্তি প্রদর্শন করে বলে, এমনকি ১৯৪৮ সালের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায়ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে নিরঙ্কুশ মর্যাদা দেওয়া হয়নি, বরং উপরোল্লিখিত শর্ত দ্বারা নিয়ন্ত্রণযোগ্য করা হয়েছে। গত বছর মার্চে ভারত সরকার সামাজিকমাধ্যম কোম্পানিগুলোকে উৎসাহিত করে সচেতনতা বাড়ানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করতে, যার দ্বারা ওইসব কোম্পানি ভুয়া, আপত্তিকর প্রভৃতি ধরনের তথ্য প্রতিহত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। ভারত সরকার ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে নতুন নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম গ্রহণ করে যার মধ্যে রয়েছে ‘ডিজিটাল ইথিকস’ ব্যবস্থা যার দ্বারা সামাজিক গণমাধ্যম কোম্পানিগুলোকে বাধ্য করে বিক্ষুব্ধ এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের দাবি বিবেচনার জন্য ভারতে দফতর খুলতে, যে দফতর আপত্তিকর প্রচার বা প্রকাশনার সূত্র উন্মোচন করতে পারবে। ২০০০ সালে ভারতীয় সংসদ ‘ইনফরমেশন টেকনোলজি’ আইন প্রণয়ন করে। ২০০৯ সালে প্রণয়ন করা হয় ‘টেকনোলজি (প্রসিডিউর অ্যান্ড সেফটি ফর ব্লকিং অ্যাক্সেস অব ইনফরমেশন) রুলস ২০০৯’, যেটি ব্লকিং রুল নামেই পরিচিত। এ আইন দ্বারা ভারত সরকার সামাজিক গণমাধ্যমে প্রচারিত ভুয়া এবং আপত্তিকর প্রচারণা রুদ্ধ করতে পারে। ২০১৭ সালে ভারত সরকার ‘টেম্পোরারি সাসপেনশন অব টেলিকম সার্ভিসেস (পাবলিক ইমারজেন্সি অর পাবলিক সেফটি) রুলস ২০১৭’ প্রণয়ন করে। ভারত সরকারের এসব উদ্যোগের মুখে ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ এবং গুগল কোম্পানিগুলো তাদের নিজ নিজ মালিকানার সামাজিক মাধ্যমগুলো ব্যবহৃত তথ্য/সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার নিশ্চয়তা প্রদানে গুরুত্ব প্রদান করে, বিশেষ করে রাজনীতিভিত্তিক তথ্য/সংবাদগুলোকে কঠোরতর পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তারা ভারত সরকার এবং ভারতের নির্বাচন কমিশনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য হয় প্রাথমিকভাবে নেতিবাচক অবস্থানে থাকার পরও। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফেসবুক এ মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে রাজনীতিভিত্তিক বিজ্ঞাপনে না-দাবিমূলক (DISCLAIMES LABELS) ছাপ ব্যবহার করতে হবে, যাতে এর সত্যতা অনিশ্চিত এবং প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যায়। একই সঙ্গে ফেসবুক ভুয়া অ্যাকাউন্টগুলো বন্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং প্রয়োজনে তৃতীয় পক্ষের সহযোগিতা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। হোয়াটসঅ্যাপও বহুবিধ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে, যার মধ্যে রয়েছে প্রতিটি হোয়াটসঅ্যাপ কাস্টমারের ব্যবহারসংখ্যা সর্বোচ্চ পাঁচটিতে সীমিত করা। তা ছাড়া এ কোম্পানি একটি ‘তথ্য যাচাইয়ের হটলাইন’ চালু করেছে।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অপব্যবহার করে সংশ্লিষ্ট দেশসমূহে গোলযোগ সৃষ্টিসহ অন্যান্য বিপজ্জনক পরিস্থিতি রোধকল্পে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আইন প্রণয়ন করেছে। যেসব দেশ কঠোর আইন করেছে তার মধ্যে রয়েছে- জার্মানি, রাশিয়া, ফ্রান্স, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কোরিয়া ইত্যাদি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর অপব্যবহারের মাধ্যমে সুযোগসন্ধানী ব্যক্তি এবং গোষ্ঠী যে বিভিন্ন দেশে অমঙ্গলকর এবং বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ধুয়া তুলে, এতগুলো দেশ বিশেষ করে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, যারা মত প্রকাশসহ অন্য মানবাধিকার রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তাদের প্রণীত নতুন আইনগুলো পুনরায় প্রমাণ করছে যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ নয়।
এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে বাংলাদেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এ দেশে আইনি পন্থায়, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠিত সরকারকে অসাংবিধানিক, বেআইনিভাবে উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে একাধিক কুচক্রী মহল। এদের মধ্যে রয়েছে অনেক ফেরারি আসামি যাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বিভিন্ন আদালতের হুলিয়া রয়েছে বা যারা বাংলাদেশের আদালতের বিচারের মাধ্যমে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে বিদেশে পালিয়ে আছে। তারা অপপ্রচার, ঘৃণার বাণী, দেশদ্রোহীমূলক বাণী ছড়াচ্ছে বিরামহীন, সামরিক ও পুলিশ বাহিনীকে উসকানি দিচ্ছে, অনেক সময় তাদের এবং র্যাবের বিরুদ্ধে কুৎসা রটাচ্ছে। দেশের বাইরে থাকায় তারা আমাদের আইন প্রয়োগকারীদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের অপপ্রচার বন্ধ করার জন্য আমাদের কর্তৃপক্ষ যতবারই চেষ্টা করেছেন ততবারই ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ এবং গুগল মালিকরা প্রথমত জিজ্ঞেস করেছেন বাংলাদেশের কোন আইনবলে তাদের প্রচারণা বন্ধ করা যায় আর দ্বিতীয়ত মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা।
তাদের প্রথম প্রশ্নটি নিয়েই আলোচনা প্রয়োজন, এসব অপপ্রচার রোধে আমাদের দেশে যেসব আইন রয়েছে, আধুনিক প্রকৌশলগত উৎকর্ষের কারণে সামাজিক গণমাধ্যম প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত প্রযুক্তির ক্রমউন্নয়নের সঙ্গে এ প্রাচীন আইনগুলোকে সেকেলেই বলতে হয়। আমাদের দেশে যে কটি আইন রয়েছে তা হলো- মানহানি, দেওয়ানি, ফৌজদারি, তথ্যপ্রযুক্তি ও আদালত অবমাননা আইন। এ ধরনের আইন যুক্তরাজ্য, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে বহুকাল ধরে থাকার পরও তারা সামাজিক গণমাধ্যম ব্যবহারকারী নতুন ধরনের অপরাধীদের প্রতিহত করতে বাধ্য হয়েছে নতুন সময়োপযোগী আধুনিক আইন করতে আর ফলও হয়েছে মঙ্গলকর। এসব আইনের কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোও বাধ্য হয়েছে ভারত, যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য দেশের দাবি মেনে নিতে। আমাদের দেশে এই নতুন শ্রেণির আক্রমণকারীদের অপরাধমূলক উপদ্রব বন্ধের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছে ভারত, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার অনুকরণে নতুন আইন প্রণয়ন করে সামাজিক গণমাধ্যম কোম্পানিগুলোকে প্রভাবিত করা। কোম্পানিগুলো মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করে বিধায় আমাদের সংবিধানে এবং সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর যেসব সীমাবদ্ধতা আরোপিত রয়েছে তারও উল্লেখ থাকতে হবে যাতে কোম্পানিগুলোকে বোঝানো যায় যে পৃথিবীর অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো আমাদের সংবিধানে প্রদত্ত মত প্রকাশের স্বাধীনতাও শর্তমুক্ত নয়। সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র এবং ইউরোপীয় মানবাধিকার কনভেনশনেও যে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর রয়েছে যুক্তিসংগত সীমাবদ্ধতা, তা-ও ব্যক্ত করার প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ করে সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ২৯(খ) এবং ২৯(গ) অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা সীমাবদ্ধতার কথাও তাদের জানিয়ে দিতে হবে।
আরও জানাতে হবে ইউরোপীয় মানবাধিকার কনভেনশনের ১০ (২) অনুচ্ছেদের কথা যেখানে উল্লেখ রয়েছে- ‘এসব (মত প্রকাশের) স্বাধীনতার সঙ্গে কর্তব্য এবং দায়িত্বও সম্পৃক্ত রয়েছে যার কারণে এগুলোর ওপর এমন সব ফর্মালিটি, শর্ত, সীমাবদ্ধতা অথবা ফৌজদারি শাস্তির বিধান প্রয়োগ করা যাবে, যা সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের আইনে রয়েছে এবং যেগুলো গণতান্ত্রিক সমাজসমূহে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, অখণ্ডতা, গণশৃঙ্খলা, অরাজকতা এবং অপরাধ ঠেকানোর জন্য, স্বাস্থ্য এবং নৈতিকতা রক্ষার জন্য, অন্যের অধিকার রক্ষার জন্য অপরিহার্য। এ ছাড়া ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালত এবং ব্রিটিশ, আমেরিকা ইত্যাদি দেশের আদালতগুলো মত প্রকাশের অধিকারের ওপর যেসব সীমাবদ্ধতার দাবি স্বীকৃতি দিয়েছে সেসব রায়ও উল্লেখ করতে হবে। ২০০২ সালে যুক্তরাজ্যের দ্বিতীয় শীর্ষ আদালত, কোর্ট অব আপিল, রানী-বনাম-পেরিনের সাজার বিরুদ্ধে আপিল খণ্ডন করে বলেছিল মত প্রকাশের স্বাধীনতা মানে যা ইচ্ছা তা বলার অধিকার নয়, সেখানে সমাজের বৃহত্তর স্বার্থ অবশ্যই দেখতে হবে। এভাবে নতুন আইন প্রণয়ন করলে এবং অন্যান্য দেশ যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তা অনুকরণ করলে আমরাও সামাজিক গণমাধ্যম মালিকদের প্রভাবিত করতে সফল হব, যা আমাদের দেশের নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা, ধর্মীয় মৌলবাদ প্রতিহত এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জিইয়ে রাখার জন্য অপরিহার্য।
লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি। সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন